ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

জেলায় জমি হস্তান্তরে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

জেলায় বর্তমানে জমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া সর্বনিম্ম পর্যায়ে। হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিগত বৎসরগুলো হার মানিয়েছিল ২০১৫ সালকে। অতিরিক্ত মৌজা রেইট বর্ধিত হওয়ার কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে। যার কারণে এই খাত থেকে পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায়ে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। জেলার উন্নয়নে ও সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জমির মৌজা রেইট। যা গত ১০ বৎসরে বেড়েছে ১২ গুণ। কোন কোন জমির শ্রেণীর ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি। জেলায় সর্বশেষ জমির মৌজা রেইট নির্ধারণ করা হয় ২০১৪ সালে। নির্ধারিত এসব মৌজা রেইট এতই অতিরিক্ত যে গত ২০১৫ ও চলতি ২০১৬ সালে পুনরায় মৌজা রেইট নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়নি। তারপরও বর্তমানে যে মৌজা রেইট দিয়ে জমি রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চলছে তাও বর্তমান বাজার ভাউ মূল্যকে হার মানাবে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট দফ্্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভাষ্যমতে, যেসব এলাকায় জমির মৌজা রেইট উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা যদি তা অবগত করান তবে কমিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফ্্তরে অভিযোগ জানালেও কাজ হয়না বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। ভুক্তভোগীদের দাবি, বর্ধিত মৌজার রেইটের বিষয়টি ২০১৩ সালে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির আহবায়ক ফজলে রাব্বী মিয়া’কে অবগত করান জেলার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী, দলিল লিখক, জেলার সুশীল সমাজ। এরপর গত ২১ ডিসেম্বর সংসদীয় উপ-কমিটির আহবায়ক ও সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের নেতৃত্বে ৫ সদস্যদের কমিটি সদর সাব-রেজিষ্ট্রী অফিস ও রেকর্ড রুম পরিদর্শনে আসলে বিষয়টি তখনও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়। মৌজা রেইট ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমাধার আশ্বাস দিলেও তাহা সুরাহা হয় না। এভাবে জানানোর পরও যদি সংশ্লিষ্ট বিষয় বাস্তবায়নে সুফল পাওয়া না যায় তবে তা জেলাবাসীর জন্য দূর্ভাগ্যজনক।
সদর সাব-রেজিষ্ট্রী অফিস সুত্রে জানা গেছে, জেলার ৮ উপজেলায় ১৮৮টি মৌজা রয়েছে। তার মধ্যে মহেশখালী-টেকনাফের কয়েকটি মৌজায় জমি বেচা-বিক্রি স্থগিত। ৩৩টি মৌজার জমি বেচা-বিক্রিতে আবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে জমি হস্তান্তরের অনুমতি নিতে হয়। সবমিলিয়ে যে ক’টি মৌজায় জমি বেচা-বিক্রি হচ্ছে তাও বর্তমান বাজার মূল্যের ১২/১৩ গুণের চেয়ে বেশি।
সূত্রে আরও জানা যায়, সদর উপজেলায় ১৯টি মৌজায় জমি হস্তান্তর হয়। এসব মৌজার উপর ৪৪টি শ্রেণী লক্ষ্যনীয়। প্রতিটি শ্রেণীর জমির মৌজা রেইট ভিন্ন ভিন্ন। দেখা যায়, ২০০৭ সালে কক্সবাজার পৌরসভার নাল শ্রেণী জমির মূল্য ছিল প্রতি শতকে (৩ কড়ায়) ৮৫,৮৪৬ টাকা, একই শ্রেণী মূল্য ২০০৮ সালে ১,২৫,৬৩৭ টাকা। ২০০৯ সালে তা বৃদ্ধি করে করা হয় ১,৮৪,৬৪২ টাকা। পুনরায় ২০০৯ সালে আবারও বৃদ্ধি করা হলে একই শ্রেণীর জমির মূল্য দাঁড়ায় ৪,৩১,৬০৫ টাকায়। ২০১১ সালে করা হয় ৫,০৮,২৬৪ টাকা। একই জমির মূল্য ২০১২ সালে করা হয় ৫,২১,৪২৬ টাকায়। এভাবে ২০১৩ সালে নির্ধারণ হয় ৯,১১,২৭৮ টাকা। প্রতি বৎসরের ন্যায় ২০১৪ সালে করা হয় ১০,৩৫,১৯১ টাকায়। এসব জমির মৌজা রেইট এতই বেশি ছিল যে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে আর বাড়ানো সম্ভব হয়নি। একইভাবে প্রতিটি শ্রেণীর মৌজা রেইট এভাবে বর্ধিত করা হয়। এভাবে জেলার সদর উপজেলা, চকরিয়া, টেকনাফ, রামু, পেকুয়া, উখিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী উপজেলার ১৮৮টি মৌজায় জমির গড় মূল্য বৃদ্ধি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধির অভিমত, যে হারে জেলায় জমির মৌজা রেইট বর্ধিত করা হয়েছে তা বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েক গুন বৃদ্ধিতে। পৌরসভায় এমন জমিও রয়েছে শ্রেণী ভিত্তিক যেগুলো গন্ডায় বিক্রয় করা হচ্ছে ৩ লক্ষ টাকায়। কিন্তু গড় মৌজা রেইটে এসব জমির মূল্য নির্ধারিত হয় ২১ লক্ষ টাকায়, ৩৫ লক্ষ টাকায় এমনকি ৬৭ লক্ষ টাকায়ও। দেখে মনে হয় মনগড়া মৌজা রেইট। জেলার জনসাধারণের কোন মতামত এখানে প্রতিফলিত হয়নি। কল্পনার জগতে বসবাস করে উচ্চ মৌজা রেইট নির্ধারণে কক্সবাজারকে সিঙ্গাপুর বানানো সম্ভব নয়। বৎসরে যে জমি কয়েকবার হস্তান্তর করা হতো তা অতিরিক্ত মৌজা রেইট বৃদ্ধির কারণে হস্তান্তরে ধস নেমেছে। যা হলে সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হতো। সাধারণ ও মধ্যবিত্তেরতো দূরের কথা উচ্চবিত্তেরও এখন জমি ক্রয় করা নাগালের বাইরে চলে গেছে।
কেন্দ্রিয় দলিল লেখক সমিতির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোছাইন জানান, ‘বাজার ভাউ মূল্যের সাথে সংশ্লিষ্ট রেজিষ্ট্রী অফিসের নির্ধারিত গড় মৌজা রেইটের কোন সামঞ্জস্য নেই বললেই চলে। পৌরসভায় এমন জায়গাও রয়েছে যেগুলো বিক্রয় করা হয় গন্ডায় (৬ কড়ায়) ৫ লক্ষ টাকায়। কিন্তু এসব জমির গড় মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৫ লক্ষ টাকায়। যেসব জমি ক্রয় করা হয় ৫ লক্ষ টাকায় সেসব জমি রেজিষ্ট্রেশনে খরচ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ টাকায়। মৌজা রেইট বৃদ্ধির কারণে ক্রয় মূল্যের চেয়ে জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌজা রেইট বর্ধিত হওয়ায় জমি হস্তান্তরে ধস নেমেছে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত রেজিষ্ট্রী সম্পাদন না হওয়ায় সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।’
জেলা রেজিস্ট্রেশন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পৌরসভার কবলা দলিল সম্পাদনে খরচ হিসেবে স্ট্যাম্প ফি-৩% আয়কর-৩%, স্থানীয় কর-৩%, রেজিঃ ফি-২% করে। এছাড়াও জমি হস্তান্তরের অনুমতি খরচ, রাইটিং, খরচ সহ প্রতি লক্ষ টাকায় খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। একইভাবে মফস্বল এলাকায় (পৌরসভার বাইরে) ভূমি সম্পাদনে খরচ হিসেবে স্ট্যাম্প ফি-৩% আয়কর-১%, স্থানীয় কর-৩%, রেজিঃ ফি-২%, নগদ স্ট্যাম্প, দলিল রাইটিং খরচসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে প্রায় প্রতি লাখে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আবার স্থিত ভূমিতে দালান থাকলে তার জন্যও গুণতে হচ্ছে ভ্যাট ও উৎসের আয়কর।
এতো উচ্চ মৌজা রেইটের মধ্যে প্রতি লাখে ১১/১২ হাজার টাকা ব্যয় কখনো সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট দফ্তরের দরকার ছিল হয়তো মৌজা রেইট কমানো, নয়তো রেজিষ্ট্রেশন খরচ কমানো। রেজিষ্ট্রেশন খরচ ও মৌজা রেইট দুইটি বিষয় একসাথে বর্ধিত হওয়ার কারণে জমি ক্রয়-বিক্রয় এখন নাগালের বাইরে। বিষয়গুলো ভবিষ্যতে জমি হস্তান্তরকে আরও ধস নামাবে। সরকার গুরুত্বপুর্ণ এই খাত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায়ে। এমনটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন সদর সাব-রেজিষ্ট্রী অফিসে রেজিস্ট্রেশন সম্পাদন করতে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা।
অতিরিক্ত মৌজা রেইট বর্ধিত হওয়ার কারণে গত বৎসর দলিল সম্পাদন হয় মাত্র ২০১৯০টি। যা এর আগের বৎসর অর্থাৎ ২০১৪ সালেও ছিল ২৬৩২৯টি। মাত্র কয়েক বৎসর আগে ২০১১ সালেও এর পরিমাণ ছিল ২৯৫৯৩টি। কক্সবাজার জেলা রেজিস্ট্রেশন কার্যালয় হতে জানা যায় সর্বনিন্ম দলিল সম্পাদন হয় ২০১৫ সালে।
জেলা রেজিস্ট্রার মো. আশরাফুজ্জামান জানান, ‘বর্তমানে আগের মৌজা রেইট জমি রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে। বর্ধিত হওয়ায় ২০১৬ সালে নতুন করে মৌজা রেইট নির্ধারণ করা হয়নি। তবে এমুহুর্তে মৌজা রেইট কমানোর কোন পরিকল্পনা নেই।’ গত ২১ ডিসেম্বর সংসদীয় উপ-কমিটির আহবায়ক সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবিষয়ে আশ্বাস দিলেও কোন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান তিনি। তবে মৌজা রেইট অতিরিক্ত বর্ধিত হওয়া সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরা এবিষয়ে লিখিতভাবে জানালে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জানান জেলা রেজিস্ট্রার মো. আশরাফুজ্জামান।

পাঠকের মতামত: